গাজীপুরের গাজী বংশের ইতিহাস

গাজীপুরে গাজীদের প্রথম পুরুষের নাম “পাহলোয়ান শাহ্ গাজী”। তিনি চতুর্দশ শতাব্দীতে ভাওয়াল পরগণা তথা আজকের গাজীপুর জেলার প্রথম শাসক ছিলেন। তার রাজধানী ছিল, কালীগঞ্জ উপজেলার চৌড়া গ্রামে, এখানেই তিনি সমাহিত হন।

*শাহ্ কারফরমা খাঁ গাজী* ---- পাহলোয়ান শাহ গাজীর পুত্র,
শাহ কারফরমা গাজী, গাজীদের দ্বিতীয় শাসক। তিনি ছিলেন সুফী সাধক, এলাকায় তিনি অনেক মসজিদ নির্মাণ ও দীঘি খনন করেন এবং এলাকায় ব্যাপক ভাবে ইসলাম প্রচার করেন। ইসলাম প্রচারে তিনি ছিলেন
গাজীদের প্রধান সেনাপতি।

*তৃতীয় শাসক কাইয়ুম খাঁ গাজী*
-----তৃতীয় শাসকের নাম কাইয়ুম খাঁ গাজী । তার সময়ে দিল্লির বাদশাহ ছিলেন মুহাম্মদ বিন তুঘলক।

*চতুর্থ শাসকের ভাওয়াল খাঁ গাজী*
----তার সময়ে দিল্লির শাসক ছিলেন শেরশাহ। শেরশাহ এর সময় ভারত কে ৪৭ এবং বংঙ্গ দেশকে ১৯টি ভাগে সরকারে বিভক্ত করেন।এই ১৯টি সরকার আবার৩২ টি মহল বা পরগণায় বিভক্ত করেন। এর একটি পরগনার নাম করা হয় "ভাওয়াল" গাজীর নামে ভাওয়াল পরগণা। তার সময়ে বাংলার শেষ সুলতান ছিলেন গিয়াস উদ্দীন মাহমুদ শাহ।ভাওয়াল গাজীর প্রশাসনিক রাজধানী ছিল কালীগঞ্জের চৌড়া গ্রামে এবং সামরিক সদর দপ্তর ছিল কাপাসিয়ার টোকে। তিনি কাপাসিয়ার দুর্গাপুর ইউনিয়নে ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও তিন কিলোমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট উঁচু মাটির দেয়াল দ্বারা ঐতিহাসিক একডালা দুর্গ নির্মাণ করেন।

* পঞ্চম শাসক ফজল গাজী*
------বাংলার বারো ভূইয়াদের মধ্যে অন্যতম শাসক।ঈসা খাঁ মোগলদের আক্রমণে পরাস্ত হয়ে ভাওয়াল পরগণাতে আশ্রয় নিলেন। ১৫৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঈসা (কালীগঞ্জ) বক্তারপুর গ্রামে মৃত্যু বরণ করেন, ঐ গ্রামেই তাকে সম্মানের সহিদ সমাহিত করা হয়।
ফজল গাজী ১৬০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

*ষষ্ঠ শাসক ছিলেন বাহাদুর গাজী*
--শীতলক্ষ্য ও বিল-বেলায়ের পশ্চিম দিয়ে বয়ে যাওয়া চিলাই নদীতে তার নৌবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান ছিল।মোঘল নৌবাহিনীর সহায়ক নৌবাহিনী " ছিল বাহাদুর গাজীর।তিনি ১৬৪৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

*সপ্তম শাসক ছিলেন সোনা গাজী*------তার সময়ে কালীগঞ্জের চৌড়া ও কাপাসিয়া মসলিন কাপড়ের উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল।১৬৫৯ সালে সোনা গাজী মৃত্যু বরণ করেন।

*অষ্টম শাসকছিলেন কাশেম গাজী*----তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেব এর নিকট হইতে পরগনার মালিক হিসেবে শাহী সনদ আনেন।কাশেম গাজীর নামানুসারে সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের নামকরন করা হয়।তার আমলে কালিগঞ্জের নাগরী গ্রামে ১৬৮০ সালে পর্তুগীজ খ্রিস্টান মিশনারীরা বিখ্যাত গির্জাটি নির্মাণ করেন এবং মীর জুমলা টঙ্গীর ব্রীজ নির্মাণ করেন।
ফজল গাজীর ছোট ভাই চাদঁ গাজীর পুত্র তালেপ গাজীর নামে তালেপাবাদ পরগনার নামকরন করা হয়।যা বর্তমানে কালিয়াকৈর উপজেলার তালিমাবাদ এলাকা নামে পরিচিত। চাদঁ গাজীর নামে চন্দ্রা নামকরন করা হয়, তিনি চন্দ্রাতে বসবাস করতেন।
চাদঁ গাজীর নামে চাদঁ প্রতাপ ও তার ভাই সেলিম গাজীর নামে সেলিম প্রতাপ পরগণার নামকরণ করা হয়।
গাজী বংশের বিখ্যাত জমিদার কাশেম গাজী ১৬৯৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

*নবম শাসকের নামঃ
বরকত গাজী*-----বরকত গাজীর নাম অনুসারে (বক্তারপুর) গ্রামের নাম করন করা হয় (কালিগঞ্জ) এই বক্তারপুর গ্রামেই শায়িত আছেন বারো ভুঞা নামে খ্যাত ঈছা খাঁর মাজার সমাধি। তার সময়ে রাজস্ব আদায়ে পাশশালা বন্দোবস্ত ছিল, দেওয়ান ছিলেন মুরশিদ কুলী খান। তিনি ১৭০৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

*দশম শাসক ছিলেন মাহতাব গাজী-
---তিনি ১৭১৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

একাদশ শাসক ছিলেন দৌলতগাজী--------তার সময়ে জমিদারীর সীমানা নিয়ে ঢাকার নায়েব নাজিমের সাথে মামলা হয়।
মুরশিদাবাদে দায়েরকৃত মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন বিক্রমপুর তথা আজকের মুন্সীগঞ্জের কুশধ্বজ চক্রবর্তী।মামলায় কুশধ্বজের ওকালতিতে দৌলত গাজী জয় লাভ করেন।এতে খুশি হয়ে কুশধ্বজকে রায় উপাধি দেন, এবং জমিদারীর দেওয়ান পদ দান করেন।

কুশধ্বজের মৃত্যুর পর তার ছেলে জানকী নাথ চক্রবর্তী ওরফে বলরাম রায় দেওয়ান পদ লাভ করেন।
নিঃসন্তান দৌলত গাজী ১৭৩৬ সালে হজ্জ্ব করতে মক্কায় যান এবং ফেরার পথে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৭৩৭ সালে ভাওয়াল জমিদারীর পাঁচশালা বন্দোবস্ত শেষ হয়। এসময় দেওয়ান বলরাম ও তার সহযোগীরা চক্রান্ত করে জমিদার গাজীদের ৪৮৩০০ টাকা রাজস্ব সময়মতো প্রেরন না করে বাকি ফেলেন। ভাওয়ালের রাজস্ব প্রেরনের ব্যর্থতার জন্য ভাওয়াল জমিদারি নিলামে উঠে এবং কুচক্রী বলরাম ও তার সহযোগীরা ভাওয়াল জমিদারি নিলামে ক্রয় করে।




অতি বিশ্বাসের কারনে অবসান হয় গাজী বংশের দীর্ঘ দিনের জমিদারি শাসন। এরপরই ভাওয়াল রাজাদের শাসনামল শুরু হয়।

গাজীপুর নামটি আজও ঐতিহাসিক গাজী বংশের নাম ধরে রেখেছে।